নিরুদ্দেশ পিতার খোঁজে

 

কামরুল হোসাইন দিদার।

সকালে নাস্তার পর বের হলাম । উদ্দেশ্য বাড়ি যাওয়া । কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে টুপি ঠিক করে হাঁটতে লাগলাম ফুটপাত ধরে । সামনের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে বাড়িতে যাবো । ভাবতেই অবাক লাগছে , কিভাবে দিনের পর দিন কেটে গিয়ে ছুটির দিন এসে পড়লো । এই তো কিছুদিন আগে মাদরাসায় গিয়েছিলাম । মাঝে দুই মাস চলে গিয়েছে । অথচ মনে হচ্ছে , এই তো পরশু মাদরাসায় গেলাম আর আজ বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ি খুঁজছি । আসলে সময় কারো জন্য বসে থাকে না -এটা তার চাক্ষুষ প্রমাণ । বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি , বাস এখনো আসে নি ।


সময় লাগবে । তাই ভাবলাম , একটু বাহির থেকে ঘুরে আসি । ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম । কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি , এক যুবক দাড়িঁয়ে আছে । বয়স ২৮ বা ৩০ হবে । এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে মনে হলো । কাছে গিয়ে সালাম দিলাম , উত্তর দিলো না । এক পলক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , তুমি কি মাদরাসায় পড়ো ? আমি বললাম , জি ! সে আমার কথা শুনে কেঁদে উঠলো ।কাঁদতে কাঁদতে বললো , আমিও একসময় মাদরাসায় পড়তাম । বলেই আবার কেদেঁ উঠলো । আমি বুঝলাম , হয়তো মাদরাসা নিয়ে তার জীবনে অনেক বড় ঘটনা রয়েছে । জিজ্ঞাসা করলাম , আপনার জীবনে হয়তো কষ্টের কোনো ঘটনা রয়েছে , যদি আমাকে বলতেন ।


তিনি বললেন , কষ্ট আর কি বলবো ভাই , ঠিক আছে বলছি । আমার বয়স যখন ১১ বছর সে সময় আমার বাবা আমাকে মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেন । তার ইচ্ছা ছিল , আমাকে হাফেজে কোরআন বানাবেন । কিন্তু আমি মাদরাসায় পড়ালেখা করতে চাই নি । তাই মাত্র দুই বছর পর আমি মাদরাসা থেকে পালিয়ে আসি । বাবা-মা কষ্ট পেলেন । কিন্তু কিছু বললেন না । তারপর আমি স্কুলে ভর্তি হলাম । পড়ালেখা শেষ করে যখন বের হলাম তখন আমি যুবক ।


এক হোটেলে ম্যানেজার হিসেবে চাকুরি শুরু করলাম । কয়েক বছর চাকুরির পর হোটেলের মালিক তার মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দিতে চাইলেন । বাবা-মাকে না বলেই আমি সম্মতি দিলাম । বিয়ের আগের রাতে তাদের জানালাম । তারা কষ্ট পেলেন । বাবা শুধু এতুটুকু বললেন , তোমার যা ইচ্ছা , করো । তবে এমন কাজ করো না , যাতে আমরা কষ্ট পাই । বিয়ে করলাম । সবকিছু ঠিক ছিল । বিপত্তি ঘটলো কিছুদিন পর। একদিন আমার শশুর ফোন করে বললেন , বাবা , আমি হয়তো আর বেশিদিন বাচঁবো না । আমার ঢাকায় একটা বিশাল হোটেল রয়েছে । তোমরা সেখানে চলে যাও , সেই হোটেলের দেখাশুনা করো , আর আমার মেয়ের প্রতি খেয়াল রেখো ।


তার কথামত স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসলাম । এখানে এসে প্রথম প্রথম বাবা-মায়ের সাথে ফোনে কথা হতো । কিন্তু কাজের চাপে কিছুদিন পর থেকে সেটা আর হলো না । তারপর কয়েক বছর কেটে গেলো । একদিন হঠাৎ বাবা আমার বাসার ঠিকানা জেনে বাসায় চলে এলেন । আমাকে দেখেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন , তোর মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন । তাই আমি তোর সাথে থাকবো বলে এখানে চলে এসেছি । আমি তাকে আমার সাথে থাকতে দিলাম । কিন্তু আমার স্ত্রী চাইলো , তিনি যেন না থাকেন । তাই তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো । একদিন কি বিষয় জানি খুব ঝগড়া হলো । আমি বকাঝকা করে বাবাকে ঘর থেকে বের করে দিলাম । কিন্তু তখনও আমি বুঝতে পারি নি , নিজের কত বড় ক্ষতি আমি করেছি । কিছুদিন পর আমার স্ত্রী বললো , সে আর আমার সাথে থাকতে পারবে না ।


সে আমার কাছে তালাক এবং তার বাবার সম্পত্তি দাবী করে কোর্টে কেস করলো । কেসে আমি হেরে গেলাম । আমার সবকিছু নিয়ে গেল । আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম । কিছুই রইলো না আমার কাছে । বুঝলাম , এটা বাবাকে কষ্ট দেয়ার ফল । এরপর একটি বেসরকারি অফিসে কাজ শুরু করি । আর সুযোগ পেলে বাবাকে খুঁজতে থাকি এখানে ওখানে । যদি কোনোদিন পেয়ে যাই , তাহলে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবো ।


অনেকক্ষণ ধরে লোকটার ঘটনা শুনলাম । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি , অনেক সময় হয়ে গেছে । লোকটাকে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি , বাস এসে গেছে । বাসে বসে লোকটার কথা চিন্তা করতে লাগলাম । তা ঘটনা আমাদের গ্রামের মাদরাসার বাবুর্চি রহিম চাচার ছেলের মত । তিনিও এভাবেই তার ছেলের ঘটনা আমাদের বলেছিলেন । আচ্ছা , এই লোকটি কি রহিম চাচার ছেলে নয় তো ! তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে ফুটপতে তাকালাম । নাহ ..................... লোকটা আর আগের জায়গায় নেই । চলে গেছে নিরুদ্দেশ পিতার খোঁজে ।


ওয়েবসাইটে আপলোড , আব্দুর রহমান আল হাসান

পাওয়ার ডোনেট , www.abdurrahmanalhasan.xyz

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Close Menu